Currently set to Index
Currently set to Follow
Bangla Book Pdf Download (All)

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উক্তি

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে বেশ কিছু উক্তি তুলে ধরা হল।

১। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি । ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১)

২। বলতাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি । (অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১ )

৩। এই সময় পাঞ্জাবে প্রগতিশীল লেখকদের একটা কনফারেন্স হয়। লেখক আমি নই, একজন অতিথি হিসাবে যোগদান করলাম। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৪২ )

৪। ১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৮ )

৫। একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী )

৬। সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বাস করা আমাদের কর্তব্য। কোন যুদ্ধ জোটে যোগদান করার কথা আমাদের চিন্তা করাও পাপ। কারণ,  আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য করা দরকার। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৭৯ )

৭। শেখ বংশ কেমন করে বিরাট সম্পদের মালিক থেকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে গিয়েছিল তার কিছু কিছু ঘটনা বাড়ির মুরুব্বিদের কাছ থেকে এবং আমাদের দেশের চারণ কবিদের গান থেকে আমি জেনেছি। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৩ )

৮। আমি চলে আসলাম ওদের কাছে। দিনভর বই পড়তাম, রাতে ঘুরে বেড়াতাম । ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৬৬)

৯। কোরআন শরিফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি । ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৮০)

১০।  লাহোর রওয়ানা করলাম। খাজা আব্দুর রহিম পূর্বে আই-সি-এস ছিলেন, খুবই ভদ্রলোক। আমাকে তার কাছ রাখলেন, ‘জাভেদ মঞ্জিলে’। ‘জাভেদ মঞ্জিল’ কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তার মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী ;  পৃষ্ঠা ২১৭ )

১১। শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বক্তৃতা চলছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি তবুও আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২২৮)

১২। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশ ত্যাগ করে  রাশিয়ায় আছেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২২৯)

১৩। গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণীর লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দর করে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যায় না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই বেশি দেখছে। পাকিস্তান কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই। ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২০৯)

১৪। জনতার বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসক যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২১০)

১৫। আমি, বেগম হককে ভাবী বলতাম, ভাবী আমাকেও দু’একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন, আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি (জেলে) ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৬৯)

১৬। মাস্টার সাহেব একটা মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং সেই চাউল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৯)

১৭ । তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক… পনের ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ৯)

১৮। ইংরেজের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশে দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করছে। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, – একটু ফেন দাও। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। হোস্টেলের যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেই, কিন্তু কি হবে এতে? এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ১৮)

১৯। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটি দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান চাই। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৭)

২০। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৪৮)

২১। পানির দেশের মানুষ আমরা, পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৫৬)

২২। দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোন বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওয়ানা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষ মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়াবার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোন মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে – কখন তাদের স্বামী ভাই বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়- তখন নৌকা রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথ রোধ করা হল। ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম। শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধান নামিয়ে রেখে লোকগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হল। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা সমিতি করলাম। সরকারি কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম কিন্তু কোনো ফল হল না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪)

২৩। মধুমতীর একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোনও কষ্ট হয় না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ১২৫)

২৪। যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক, পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যায়, পাঞ্জাবের রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৪২)

২৫। দিল্লি পৌঁছালাম এবং সোজা রেলস্টেশনে হাজির হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ওয়েটিংরুমে মালপত্র রাখলাম। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি দুজন প্যাসেঞ্জার নেমে গেছেন, একজন আছেন। তিনি পশ্চিম বাংলার লোক। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? আমি সত্য কথাই বললাম। লাহোর থেকে এসেছি, পূর্ব বাংলায় যাব। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। অনেক আলাপ হল, পূর্ব বাংলার মাছ ও তরকারি, পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৪৪)

২৬। দশটায় আমাকে কোর্টে হাজির করল। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্য রাখতে। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি। প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমান নাই যা আমি জানতাম না। এই শহরের আলো বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে। কিছুদূর পরেই দু’পাশে  দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারদের আমি নাম জানতাম। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতেই থানার দিকে চললাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৭৬)

২৭। আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২১৪)

২৮। সাংহাই থেকে আমরা হ্যাংচোতে আসলাম। একে চিনের কাশ্মীর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলে ফুলে ভরা এই দেশটা। হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মন হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। মেয়েরা এখানে নৌকা চালায়। আমি নৌকা বাইতে জানি। পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৩৩)

২৯। আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সেজন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২১৮)

৩০। এরপর ক্যাবিনেট আলোচনা শুরু হলো। অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, সে কথা আমার পক্ষে বলা উচিত না, কারণ ক্যাবিনেটে মিটিংয়ের খবর বাইরে বলা উচিত না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৬৫)

৩১। আমি হক সাহেবের (শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক) কাছে আবার হাজির হয়ে বললাম, নানা- ব্যাপার কি? এ সমস্ত কি হচ্ছে, আমরা তো মন্ত্রী হতে চাই নাই। আমাদের ভিতরে এনে এ সমস্ত ষড়যন্ত্র কেন? ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৬৭)

৩২। প্রধানমন্ত্রী, মোহাম্মদ আলী বগুড়া আমাদের তার রুমে বসতে দিলেন। হক সাহেবও (শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক) আছেন সেখানে। মোহাম্মদ আলী (প্রধানমন্ত্রী) বেয়াদবের মতো হক সাহেবের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল। এমন সময় মোহাম্মদ আলী আমাকে বললেন, কি মুজিবুর রহমান, তোমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আছে আমার কাছে। এই কথা বলে ইয়াংকিদের মতো ভাব করে পিছন থেকে ফাইল এনে টেবিলে রাখলেন। আমি বললাম, ফাইল তো থাকবেই, আপনাদের বদৌলতে আমাকে তো অনেক জেল খাটতে হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধেও একটা ফাইল প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে। তিনি বললেন, এর অর্থ। আমি বললাম, আমরা যখন ১৯৪৮ সালে প্রথম বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করি, তখন আপনি (আন্দোলন বিরোধীদের) গোপনে দুইশত টাকা চান্দা দিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার?  ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৬৮)

৩৩। আপনি তো (হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী) এখন মোহম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী। তিনি বললেন, রাগ করেছ বোধহয়। বললাম, রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কি না? তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, বুঝেছি, আর বলতে হবে না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৮৬)

৩৪। এই সময় ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে ডাকলেন, তিনি চিফ হুইপ ছিলেন। আমাকে বললেন, ‘আপনাকে এই বারটার সময় আসাম-বেঙ্গল ট্রেনে রংপুর যেতে হবে। মুসলিম লীগের একজন এমএলএ, যিনি খান বাহাদুরও ছিলেন তাকে নিয়ে আসতে হবে। আপনি না গেলে অন্য কেউ আনতে পারবে না”। আমি বেকার হোস্টেলে এসে একটা হাত ব্যাগে কয়েকটা কাপড় নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়ার সময় পেলাম না। ট্রেনে চেপে বসলাম। পৌঁছলাম রাত একটায়। পথে কিছু খেতে পারি নাই। রিকশাওয়ালা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি চিনে, আমাকে ঠিকই পৌঁছে দিল। আমি অনেক ডাকাডাকি করে তাকে তুললাম। চিঠি দিলাম। তিনি আমাকে জানেন। বললেন, ‘আগামীকাল আমি যাব’। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কি না? পথে খেয়েছি কি না? বললেন, “এখন তো রাত তিনটা বাজে, বিছানার কি দরকার হবে”? বললাম, দরকার নাই, যে সময়টা আছে বসেই কাটিয়ে দিব। একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। গতরাতে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ভাত খেয়েছি। বললাম, এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দিলে ভাল হয়’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ৩৪)

৩৫। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৩৭)

৩৬। আমাকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম তাই করতাম। আমার খুব ভাল লাগত। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৭৫)

৩৭। কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে চিন্তা করতেও ভয় হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। এদিকে হোস্টেলগুলিতে চাউল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। কোন দোকান কেউ খোলে না লুট হয়ে যাবার ভয়ে। শহীদ সাহেব বললেন, নবাবজাদা নসরুল্লাহকে ভার দিয়েছি তার সাথে দেখা কর। তিনি আমাদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গেলেন এবং বললেন, চাউল এখানে রাখা হয়েছে তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর। আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। আমরা ঠেলা গাড়ি আনলাম। কিন্তু ঠেলবে কে? আমি, নূরুদ্দিন ও নূরুল হুদা এই তিনজনে ঠেলাগাড়িতে চাউল বোঝই করে ঠেলতে শুরু করলাম। নূরুদ্দিন সাহেব তো তালপাতার সেপাই। শরীরে একটুও বল নাই। আমরা তিনজনে ঠেলাগাড়ি করে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে চাউল পৌঁছে দিলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ৬৬)

৩৮। আমি বললাম, বয়স্ক লোক না পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠান গড়ব না মনে করেছেন! দেখবেন এরাই একদিন এই জেলার নেতা হয়ে কাজ করতে পারবে। যেখানে এডভোকেট সাহেবরা যেতে পারে নাই, সে সমস্ত জেলায় আমি একলাই যেতাম এবং সভা করতাম, কমিটি গঠন করতাম। জুন, জুলাই, আগস্ট মাস পর্যন্ত আমি বিশ্রাম না করে প্রায় সমস্ত জেলা ও মহকুমা ঘুরে লীগ শাখা গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২২০)

৩৯। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। আমাদের দুজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে পুরিসিস রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। আমার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম। প্যালপিটিশন হয় ভীষণভাবে। নি:শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। অনেক লোক আছে । কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম। এই শান্তি। আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তার কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন। আমি তার কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বারবার আব্বা মা ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর কি দশা হবে? হাচিনা কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না। মহিউদ্দিন ও আমি পাশাপাশি দুইটা খাট পেতে নিয়েছিলাম। একজন আরেকজনের হাত ধরে শুয়ে থাকতাম। দুজনেই চুপচাপ পড়ে থাকি। আমার বুকের ব্যথা শুরু হয়েছে। দুইজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২০১-২০৫)

৪০। অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীরে। ডাক্তার ডাকতে হবে – কাউকেই চিনি জানি না। একজন স্বেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন, ‘আভি নেহি, থোড়া বাদ। তাকে আর দেখা গেল না। ‘থোড়া বাদই রয়ে গেল’।

‘ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ‘ইডিয়ট হোস্টেল’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২৬)

৪১। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন। আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পিছন থেকে ভাগতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৪১)

৪২। তাজউদ্দীন আহমদ (এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) আটক পড়েছে। তাকে নিষেধ করা হয়েছে গ্রেফতার না হতে। তাজউদ্দীন বুদ্ধিমানের মতো কাজ করল। বলে দিল, “আমি প্রেস রিপোর্টার”। একটা কাগজ বের করে কে কে গ্রেফতার হল, তাদের নাম লিখতে শুরু করল। আমি তাকে চোখ টিপ মারলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১১৭)

৪৩। জেলে যারা আছে, তাদের মধ্যেও দুইটা গ্রুপ ছিল। আমাদের খেলাধুলা করে সময় কেটে যেত। আমার কাছে বরকত থাকত। রাতে বরকত গান গাইত, চমৎকার গাইতে পারত। এরা দল বেঁধে ডাক্তার সাহেবের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত। বরকত ছিল দুষ্ট বেশি। ডাক্তার সাহেব আসলেই বলত, – আমার পায়ে ব্যথা, কিছু দুধ ও ডিম পাস করে দেন। সকলেই হেসে ফেলত তার কথায়।

‘খালেক নেওয়াজকে নিয়ে আর এক মহাবিপদ ছিল। ওর গায়ে বড় বড় লোম ছিল। সমস্ত গা লোমে ভরা। ছাত্ররা ছারপোকা ধরে চুপি চুপি ওর শরীরে ছেড়ে দিত’। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১১৭-১১৮)

৪৪। রাত দশটা এগারটায় হবে এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌঁছাল। সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৪৬)

৪৫। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে। আমরা যে কামরায় আছি সেখানে আমরা তিনজন ছাড়াও কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি আছে। শামসুল হক সাহেবে মাত্র দেড় মাস পূর্বে বিবাহ করেছিলেন। হক সাহেব ও তার বেগম আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। এক অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন। আমাকে বেশি কিছু বললে আমি তাকে বউ পাগল বলতাম।  ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৬৮)

৪৬। আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। এক সাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান – সবই চলত । ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১১)

৪৭। খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভাল করে, তবুও মনে হত আরও শুনি। বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, যাকে আমরা কাওয়ালী বলি। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৫৬)

৪৮। এই সময় ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরের জনাব রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন। কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তার গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তার নাড়ির সম্বন্ধ। আব্বাসউদ্দিন সাহেব, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন সাহেব গান গাইলেন। অধিক রাত পর্যন্ত আসর চলল। পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম। পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তার গান শুনছে। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে’। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।  ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা  ১১০-১১১)

৪৯। জেল অফিসের পিছনে সামান্য জায়গা ছিল। বিকালে ওখানে আমি হাঁটাচলা করতাম। এই অন্ধকূপের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জানালা নেই মাত্র একটা দরজা, তার সামনেও আবার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। রাজশাহীর একজন সিপাহির ডিউটি প্রায়ই ওখানেই পড়ত। চমৎকার গান গাইত। সে আসলেই তার গান শুনতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৮৫)

৫০। আজমীর শরীফকে বিদায় দিয়ে আবার আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম। আগ্রার দিকে, যেখানে মমতাজ বেগম শুয়ে আছেন তাজমহলকে বুকে করে। বহুদিনের স্বপ্ন তাজমহল দেখব। তাজমহলের কথা জানে না, এমন মানুষ দুনিয়ায় খুব বিরল। আমাদের দেরি আর সইছে না। মনে হচ্ছে ট্রেন খুব আস্তে আস্তে চলছে। কারণ তাজ দেখার আগ্রহ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমরা তো ভাবিনি ঠিক পূর্ণিমার দিনে আগ্রা পৌঁছাব। আমরা হিসাব করে দিন ঠিক করে আসি নাই। মনে মনে পূর্ণিমাকে ধন্যবাদ দিলাম, আর আমাদের কপালকে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হত, তাই তাকেও দিলাম।

মন তো মানছে না, কি দেখলাম ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। ভাষার উপর আমার দখলও নাই। শুধু মনে হল, এও কি সত্য। কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে যে এ অনেক সুন্দর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাজকে ভালভাবে দেখতে হলে আসতে হবে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাবার সময়, চাঁদ যখন হেসে উঠবে তখন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭)

৫১। সূর্য অস্তাচলগামী, পূর্ণ চন্দ্রের সময়ই অনেক লোক বিশেষ করে আসে। সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রঙ আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হল, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে। আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই। আর ভুলতেও পারব না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৫৯)

৫২। এক একজন এক একটা জায়গা দেখতে চায়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম তানসেনের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত তানসেনের বাড়ি দেখতে গেলাম। তার বাড়িটা প্রাসাদের বাইরে, পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি। বোধহয় সঙ্গীত সাধনায় ব্যাঘাত হবে, তাই তিনি দূরে থাকতেই ভালোবাসতেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৬০)

৫৩। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাশ ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, পাকিস্তান আন্দোলন বলে কিছু বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর। আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি, – কিছু টাকা হাত করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, – “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৬১)

৫৪। রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলেছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না। একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৬৫)

৫৫। আমাদের মামলা শুরু হয়ে গেছে, পনের দিন পর পর কোর্টে যেতে হত। যেদিন হক সাহেবের সাথে তার বেগম দেখা করতে আসতেন সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হত। সত্যই আমার দু:খ হত। দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারল না বেচারী! । আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় ফুলের তোড়া বানিয়ে দিতাম। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৬৯)

৫৬। পাটগাতি স্টেশন থেকে আমরা ওঠানামা করি। আমাকে সকলেই জানে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়ির খবর কিছু জানে কি না? যা ভয় করেছিলাম তাই হল, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকায় গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৭৬)

৫৭। জেলে মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। জানালা দিয়ে শুধু কিছু জ্যোৎস্না বা তারাগুলি দেখার চেষ্টা করেছি। আজ আর ঘরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাইরে বসে রইলাম, পুলিশ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশ কর্মচারী যিনি রাতে ডিউটি করেছিলেন, তিনিও এসে বসলেন। বাইরে শোবার ইচ্ছা করছিল, কিন্তু উপায় নাই। গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। একটু সুযোগ পেলেই আর রক্ষা নাই। অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রইলাম নদীর দিকে মুখ করে। নৌকা যাচ্ছে আর নৌকা আসছে। পুলিশদের বললাম আমার জন্য চিন্তা করবেন না, ঘুমিয়ে থাকেন। বেশি সময় বসতে পারলাম না, কোথাও সাড়া শব্দ নাই। মাত্র এগারটা বাজে, মনে হল সারা দেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু দুইখানা নৌকা চলছে, তার শব্দ পাই । ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৮)

৫৮। বিকেলে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তার পাশেই বসলাম। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কাছে তারা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ – আরও কয়েকটা কবিতার কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ২১৭)

৫৯। প্রথমে ঠিক হল, একটা যুব প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যে কোন দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে – যাকে ইংরেজরা বলে, “কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা । একমাত্র ‘কমিউনাল হারমনি’র  জন্য কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো কাজই আমাদের নাই। দুই মাস হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কোন দাবি করা উচিত হবে না।  ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ৮৫)

৬০। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হোন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন। তা না হলে কর্তৃপক্ষ মানবে না। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ; পৃষ্ঠা ১১২)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button