বইঃ নির্বাসন
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
বইয়ের ধরনঃ সামাজিক উপন্যাস
দীর্ঘ কলেবরের এই উপন্যাসটির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র মনসুরের লস্কর চরে নির্বাসিত জীবনের গল্প থেকেই বইটির সার্থক নামকরণ ‘নির্বাসন’। দেশ স্বাধীনের প্রায় এক দশক পার হলেও ১৯৮৮ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বেশ অস্থিতিশীল। রাজধানী ঢাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল-মিটিং এর হিড়িক। দেশজুড়ে তখন বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। বিপদের কথা আচ করতে পেরে নবীগঞ্জের প্রভাবশালী পাটের আড়তদার আজাহার খন্দকার তার বড় ছেলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মনসুরকে নিয়ে আসেন নবীগঞ্জে। নবীগঞ্জে তখন লস্কর চরের ডাকাত তোরাব আলী লস্করের ত্রাসের রাজত্ব। দোর্দণ্ড প্রতাপে তার ডাকাত দল ডাকাতির আগে চিরকুট দিয়ে জানিয়ে রাখে ডাকাতির দিন-ক্ষণ। আজাহার খন্দকার সেরকমই একটা চিরকুট পাওয়া সত্ত্বেও পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিলেন লস্কর চরের দুজন ডাকাতকে। খবর পাওয়ামাত্রই তোরাব আলী লস্কর খন্দকার বাড়ির ক্ষতি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। অন্যদিকে মনসুর তখন গোবিন্দপুরে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রণয়ে জড়ায় সেখানকার স্কুল শিক্ষক দেলোওয়ার হোসেনের একমাত্র মেয়ে কণার সঙ্গে। মনসুরের কাব্যিক ব্যক্তিত্ব প্রবলভাবে আকর্ষণ করে কণাকে। দুজনেই প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করে দুজনের মনকে, অনুভূতিকে। পরিবারে সম্মতিতেই বিয়ে হয় তাদের। ভাইয়ের বিয়েতে মা-মরা মনসুরের ছোটভাই মঞ্জুও বেশ খুশি। হঠাৎ একদিন তোরাব আলী লস্করের নাতনী জোহরা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় আজাহার খন্দকারের বিশাল পাটের আড়ত। দাদার হয়ে প্রতিশোধটা নিয়ে নেয় সে! এর আগেও অবশ্য তীব্র ক্ষিপ্রতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিকল্পনামাফিক পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে দুজন ডাকাতকে। লস্কর চরে তখন কলেরা মহামারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ডাকাত দলের সদস্য বাহাদুরের স্ত্রীর মৃত্যুতে তার দুগ্ধপোষ্য মেয়ে মায়ার দায়িত্ব নেয় জোহরা। অসুস্থ মায়ার ঔষধের জন্যে লস্কর চর থেকে নবীগঞ্জে যায় সে। ফেরার পথে প্রচণ্ড আহত করে কনস্টেবল নুরুন্নবীকেও। জোহরার এসব দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডে সে প্রভাব বিস্তার করে পুরো লস্কর চরে। সমগ্র বইজুড়ে সবচেয়ে রহস্যময়ী চরিত্র এই জোহরা। তার খামখেয়ালী ব্যক্তিত্বের কারণে কখনো সে শান্ত নদী; কখনো বা উত্তাল সমুদ্র! বেশ বড়সড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও খন্দকার বাড়িতে তখন উৎসবের আমেজ! কেননা, কণা তখন অন্তঃসত্ত্বা। নিজ বাড়িতে কণার যত্ন নেবার জন্যে কেউ না থাকায় তাকে তার মা শাহিনা বেগমের কাছে পাঠানো হয়। কিছু ব্যস্ততার কারণে মনসুর যেতে না পারলেও ঠিক করা হয়, সে সপ্তাহ খানেক পড়েই যাবে। কণা তার বাপের বাড়িতে বেশ অনেকদিন থাকার পরও খোঁজ নেই মনসুরের। খানিকটা দুশ্চিন্তা হলেও সেটাকে পাত্তা দেয় না কণা। হঠাৎ একদিন গোবিন্দপুরে কণার বাড়িতে হাজির হন আজাহার খন্দকার। কণারা ফিরে না আসার কারণ নিয়ে মন কষাকষির এক পর্যায়ে তারা জানতে পারে কণার আসার তিন দিন পরই মনসুর রওনা দেয় গোবিন্দপুরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মনসুরের লাপাত্তা হওয়াটা দুশ্চিন্তা দিয়ে ঘিরে ফেলে সবাইকে। ঠিক পাঁচ দিন পর সুবর্ণপুর নদীতে ভেসে উঠলো তিনটি লাশ। যার একটি মনসুরের। শোকের ছায়া তখন দু’ পরিবারেই। তবে মনসুর যে তখনো বেঁচে! লস্করের চরেই সে যাপন করতে থাকে দীর্ঘ এক নির্বাসিত জীবন। মনসুরের বেঁচে থাকার কার্যকারণ দেখাতে লেখকের পাকা লেখনির ভূমিকায় পাঠক মুগ্ধ হতে বাধ্য। লাশ তিনটির তদন্তের দায়িত্ব তখন ইন্সপেক্টর মঈনুল হোসেন ও একরামুল হকের উপর। কিন্তু জোহরা তখন মনসুরে মগ্ন। কিন্তু তার চাচতো ভাই হানিফের চোখে তখন আগুন। মনে জেকে বসেছে খুনের নেশা। কেননা, জোহরার সাথে হানিফের বিয়ে পূর্ব নির্ধারিত। জোহরাকে পাবার বাসনা তার মনে বহু আগে থেকেই পোষা। সেখানে মনসুর যেন তার পথের কাঁটা। অন্যদিকে কণা তখন মনসুরের ছেলে ‘মন’ এর মা। কিন্তু এত অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় বাবা-মা উঠেপরে লেগেছে তার বিয়ে দিতে। এ পর্যায়ে মঞ্জুকে কেন্দ্র করে হঠাৎই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। এরই মাঝে একদিন কেসের ফাইল খুলে কিছু আপাত- অপ্রয়োজনীয় বাজারের লিস্ট পান মঈনুল হোসেন। কিন্তু সেটাই ছিল গল্পের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট!
মনসুর কি তবে নির্বাসনেই কাটিয়ে দেবে বাকিটা জীবন? লাশ পাবার পরও কীভাবে সে বেঁচেছিল? লাশটাই বা কার ছিল? কণা কি কখনোই তার জন্য আপেক্ষমান অন্যতম মধুর সত্যের সাক্ষাত পাবে না? পথের কাঁটা সরাতে হানিফই বা কী করবে? জোহরার কি আর পাওয়া হবে মনসুরকে? কী ছিল বাজারের সেই লিস্টটিতে? মঞ্জুই বা কেন সম্পর্কের টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো? লস্কর চরের ডাকাতদের শেষ পরিণতিই বা কী ছিল? -এমন নানা প্রশ্নের উত্তর পাঠককে উৎকণ্ঠিত করবেই। ফলে নির্বাসনের শেষটা জানতে পাঠক হয়ে উঠবেন মরিয়া, অস্থির! বলে রাখা ভালো, লেখক উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছেন গল্পের অসমাপ্তিতে -যা পাঠককে ডুবিয়ে দেবে অদ্ভুত এক শূন্যতায়। তাই নির্বাসনের দ্বিতীয় খণ্ডের জন্যে পাঠকের মন কেঁদে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
**বইটি থেকে মনে দাগ কাঁটা কিছু উক্তি-পঙক্তিঃ
“মানুষের গভীরতম কান্না আর গভীরতম প্রার্থনা হয় একা, নিঃশব্দে আর গোপনে।”
“তোমাকে চেয়েছি অন্ধকারের মতন, একাকী ভীষণ, গভীর এবং গাঢ়,
তোমাকে চেয়েছি প্রার্থনা ও প্রেমে, যতটা রয়েছো তার চেয়ে বেশি আরো।”
“একটা তোমার মতো চাঁদের জন্য মেয়ে,
আমি জোছনা সকল হেলায় ভুলে থাকি,
একটা তোমার মতো মনের জন্য মেয়ে,
আমি হৃদয়টাকে যত্নে তুলে রাখি।”
” জগতে অনিশ্চিত অপেক্ষার চেয়ে ভয়ংকর কিছু নেই।”
“মায়া বড় ভয়ানক জাল। এই জালে একবার কেউ আটকে গেলে তার পুরোটা জীবন কেটে যায় সেই জাল ছিন্ন করতে। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যায় সেই জালে মানুষ আবারই জড়িয়ে পড়েছে। আর কখনোই বের হতে পারে না সে। কিংবা বের হতে চাওয়ার ভান করলেও ভেতরে ভেতরে হয়তো আর বের হতে চায় না সে।
Reviews
There are no reviews yet.