সত্যকথন – আরিফ আজাদ

৳ 250.00

সত্যকথন
লেখকঃ আরিফ আজাদ
.
“একজন অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের গল্প”
.
প্রায় ৫০ বছর ধরে নাস্তিকতার প্রচার চালিয়ে যাবার পর ২০০৪ সালে পৃথিবীর নেতৃত্বস্থানীয় এবং সুপরিচিত নাস্তিক অ্যান্টনি ফ্লিউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অবশ্যই এ মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন।
জীবনভর দার্শনিক অনুসন্ধানের পর, এবং একজন নাস্তিক হিসেবে নিজের প্রায় সম্পূর্ণ জীবন কাটানোর পর শেষপর্যন্ত অ্যান্টনি ফ্লিউ এই উপসংহারে পৌছোন যে সকল যুক্তিপ্রমাণ একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের দিকেই নির্দেশ করে।
.
জীবনের বেশীরভাগ সময় ধরেই নাস্তিকতায় দার্শনিক বীরপুরুষ হিসেবে পরিচিত ফ্লিউ যখন তার এই উপসংহার ঘোষণা করলেন তখন তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য নাস্তিকরা তাকে জরাগ্রস্থ, ভীমরতিতে পাওয়া বুড়ো বলে প্রমানের জন্য উঠেপড়ে লাগলো। তারা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল শেষবয়সে গিয়ে ফ্লিউ কিছু খ্রিষ্টানদের দ্বরা প্রভাবিত হয়ে নিজের মত বদলেছেন।
.
ফ্লিউ এই অভিযোগ অস্বীকার করলেন এবং নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতার দিকে তাঁর এই দার্শনিক যাত্রা বর্ননা করে একটি বই লিখলেন, There Is A God, How The World’s Most Notorious Atheist Changed His Mind।
.
কোন যুক্তি ও প্রমানের প্রেক্ষিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌছুলেন এই বইতে ফ্লিউ তা ব্যাখ্যা করলেন।
.
“এখন আমি বিশ্বাস করি এক অসীম বুদ্ধিমত্তা এই মহাবিশ্বকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে সুক্ষাতিসুক্ষ নিয়মগুলো দ্বারা এই মহাবিশ্ব পরিচালিত হয় সেগুলোর মাধ্যমে একজন স্রষ্টার ইচ্ছা ও অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়। আমি বিশ্বাস করি জীবন এবং জীবন ধারার উৎস ঐশ্বরিক।” [১]
.
অ্যান্টনি ফ্লিউ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজতান্ত্রিকদের পাঠচক্রে খুঁজে পাওয়া স্রোতের সাথে গাঁ ভাষানো নিরামিষ নাস্তিক কিংবা সামওয়্যার ইন ব্লগ বা মুক্তমনাতে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে “মুক্তচিন্তার” পতাকা উড়ানো গালিবাজ শব্দসন্ত্রাসী জাতীয় নাস্তিক ছিলেন না। খুব অল্প বয়সে নাস্তিকতার উপর একটি লেখা প্রকাশ ফ্লিউ করে দার্শনিক অঙ্গনে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত Theology and Falsification নামের এই পেপারটি গত পঞ্চাশ বছরে বারবার পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। ফ্লিউয়ের এই লেখা দার্শনিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং ফ্লিউয়ের জন্য এনেছিল একজন তুখোড় দার্শনিক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
.
পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই একাডেমিক জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ফ্লিউয়ের অবস্থান। একপর্যায়ে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর হিসেবেও দায়িত্বরত ছিলেন। তবে অধিকাংশ নাস্তিকদের মধ্যে উপস্থিত একটি বৈশিষ্ট্য থেক ফ্লিউ মুক্ত ছিলেন। অধিকাংশ নাস্তিক নিজের নাস্তিকতার দিকে যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, দশন, যুক্তি নিয়ে সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করে। কিন্তু নাস্তিকতার বিশ্বাসে সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করার সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এবং দার্শনিক যুক্তিতর্ক সম্পর্কে তারা চিন্তা করা বন্ধ করে দেয়, অথবা শুধুমাত্র নিজেদের সংকীর্ণ অবিশ্বাসের বিশ্বাসের লেন্স দিয়ে সবকিছুকে বিচার করে।
.
এই জায়গাটাতে ফ্লিউ ছিলেন আলাদা। ফ্লিউয়ের একটি দুর্লভ গুণ ছিল, “প্রমাণাদি যেদিকে নিয়ে যায় তার অনুসরণ করা”র নীতির কথা তিনি বাকি নাস্তিকদের মতো শুধু মুখে দাবি করতেন না, বরং সত্যিকার ভাবেই এই নীতির অনুসরণ করতেন।
.
ফ্লিউয়ের নিজের ভাষায় –
.
“এমনকি বিগ ব্যাং তত্ত্ব কিংবা ফাইন-টিউনিং তত্ত্ব প্রকাশের বহুপূর্বেই আমার অন্যতম সেরা দুইটি ধর্মতত্ত্ব বিরোধী বই প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু আশির দশকের শুরুর দিকে আমিএই বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা শুরু করতে বাধ্য হলাম । আমি এই কথা স্বীকার করেছিলাম যে সমসাময়িক মহাজাগতিক আবিষ্কারগুলোর কারনে নাস্তিকরা বিব্রত হতে বাধ্য। কারন থমাস অ্যাকুইনাস দশর্নের মাধ্যমে যেটি প্রমাণ করতে পারে নি [“মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে] তা মহাবিশ্বতত্ত্ববিদরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে শুরু করলেন।” [২]
.
আর এ কারনেই শেষপর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিই এবং নতুন আবিষ্কার তাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে যে – একজন বুদ্ধিমান সত্তাই এই মহাবিশ্বের উদ্ভাবন এবং ডিজাইন করেছেন। তিনি দেখলেন যে বিগ ব্যাং তত্ত্বানুসারে ধারণা করা হয় মহাবিশ্ব আনুমানিক তের বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। যদি একে সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে আমরা বর্তমানে জটিল পর্যায়ের জীব এবং জীববৈচিত্র [complex life & complexity of life] দেখি, বিবর্তনের মাধ্যমে তাতে উপনীত হবার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় না। এছাড়া, মাইক্রো বায়োলজি এবং ডিএনএ এর ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিস্কার তাকে এই সিদ্ধান্তে আস্তে বাধ্য করে যে, এসব কিছুর পেছনে অবশ্যই একটি বুদ্ধিমান সত্ত্বা আছে।
.
২০০৭ সালে বেনজামিন উইকারের সাথে সাক্ষাৎকারে ফ্লিউ বলেছিলেন –
.
“আমার সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করার পেছনে কাজ করেছে আইনস্টাইন সহ আরো বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মতের সাথে ক্রমবর্ধমান একাত্মতা যা আমি অনুভব করছিলাম। আইনস্টাইন সহ আরো অনেক বিজ্ঞানী তাদের সুক্ষদর্শিতার কারনে এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে এই মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত এবং সুসংহত জটিলতার (integrated complexity) পেছনে একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার ভূমিকা আবশ্যক। এছাড়া আমি নিজে ব্যক্তিগত এই উপসংহারে পৌছেছিলাম যে জীবন ও জীববৈচিত্র – যা মহাবিশ্বের চাইতেও বেশি জটিল – শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিমান উৎসের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়। [৩]
.
নাস্তিকরা সবসময় দাবি করে শুধু সাধারণ অশিক্ষিত, অজ্ঞ লোকেরা যারা কোন চিন্তাভাবনা করে না তারাই ধর্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু অ্যান্টনি ফ্লিউ নাস্তিকদের সব যুক্তি জানতেন। এমনকি বর্তমানে নাস্তিকরা যেসব যুক্তি ব্যবহার করে এর অনেকগুলো তিনি নিজেই দাঁড় করিয়েছিলেন। নাস্তিকতার পক্ষে তিনি ৩০টির মতো বই লিখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি অন্ধ অবিশ্বাসী ছিলেন না তাই শেষপর্যন্ত তিনি সেই উপসংহারে পৌছেছিলেন সব যুক্তি ও প্রমাণ যে দিকে নির্দেশ করছিল। আর তাই তিনি স্বীকার করে নিয়েছিল, এ মহবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যক।
.
একজন নাস্তিক হিসেবে অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের দার্শনিক পথ পরিক্রমার সবচেয়ে ইউনিক বৈশিষ্ট্য হল প্রমাণ ও যুক্তির অনুসরণের ব্যাপারে তার স্বদিচ্ছা, যা অন্যান্য নাস্তিকদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই অনুপস্থিত। যখন ফ্লিউয়ের পাশাপাশি আপনি একজন ডকিন্স, হ্যারিস কিংবা ডেনেটকে দাড় করাবেন তখন তাদের আত্বকেন্দ্রিক, উগ্র, অপরিপক্ক এবং ঝগড়াটে রূপ খুব সহজেই ধরা পড়বে।
.
.
২০১০ সালে অ্যান্টনি ফ্লিউ মারা যান। একজন আস্তিক হিসেবে কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী না হয়ে। আর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমরা সত্যকথনের পাঠকদের জন্য, কিংবা নাস্তিকদের জন্য অ্যান্টনি ফ্লিউকে আস্তিকতার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করছি না। আমরা এই কারনে অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করছি কারন নাস্তিক এবং মুসলিম – দুই পক্ষের জন্যই এতে শিক্ষণীয় বিষয় আছে।
.
নাস্তিকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়টি ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে – আর তা হল অবিশ্বাসের অন্ধ বিশ্বাস বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ ভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিষয়ে চিন্তার স্বদিচ্ছার বিষয়টি।
.
আর মুসলিমদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়টি হল আস্তিক হওয়া শেষপর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য না। নাস্তিকদের তর্কে পরাজিত করাও আমাদের উদ্দেশ্য না। যদিও আমরা স্বীকার করি এ কাজটা আনন্দদায়ক। আমাদের উদ্দেশ্য ঈমান ও বিশুদ্ধ তাওহিদ অর্জন করা। আস্তিক হওয়া মানে হেদায়েত পাওয়া না। এ হল শুধু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া। আমাদের কাজ হল বাস্তবতাকে স্বীকার করার পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আনুগত্য করা।
.
অনেক সময়েই দেখা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, কম্পারেটিভ রিলিজিয়েন নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে আমরা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে আমরা আমাদের ঈমানের দিকে আমাদের তাওহিদের বিশ্বাসের দিকে অমনযোগী হয়ে পড়ি। বুদ্ধি আপনাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে দিবে, যেমন অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের ক্ষেত্রে তা তাকে সত্য পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিল। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট না। সত্য পর্যন্ত পৌছানোর পর আমাদের দায়িত্ব শেষ না, বরং আমাদের মূল দায়িত্ব শুরু।
.
আমাদের মূল দায়িত্ব হল সত্যকে খুঁজে পাবার পর তার অনুসরণ করা। শোনা ও মানা। কারন যখন আপনি বুঝবেন মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে, যখন আপনি উপলব্ধি করবেন আপনার একজন স্রষ্টা আছে, তখন আপনি এও বুঝবেন যে এই স্রষ্টার প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে।
নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, এই সুবিশাল মহাবিশ্ব ও এই অবিশ্বাস্য জটিল ও বৈচিত্রময় জীবনের সৃষ্টিকর্তা নিরর্থক আপনাকে, আমাকে, এই সবকিছুকে সৃষ্টি করেন নি।
.
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –
.
হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে করা উচিৎ এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করোনা।
[আলে ইমরান, ১০২]
.
নিশ্চয় হেদায়েত কেবলমাত্র আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল -এর পক্ষ থেকেই।
======================
১। There Is A God, page 88
২। There Is A God, page 135.
৩। Dr. Benjamin Wiker: Exclusive Flew Interview, 30 October 2007
======================
.
সত্যকথন ডেস্ক
#সত্যকথন_১
.
আমি রুমে ঢুকেই দেখি সাজিদ কম্পিউটারের সামনে উবুঁ হয়ে বসে আছে।খটাখট কি যেন টাইপ করছে হয়তো। আমি জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। প্রচন্ড রকম তৃষ্ণার্ত।তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। সাজিদ কম্পিউটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,- ‘কি রে, কিছু হইলো?’
.
আমি হতাশ গলায় বললাম,- ‘নাহ।’
.
– ‘তার মানে তোকে একবছর ড্রপ দিতেই হবে?’- সাজিদ জিজ্ঞেস করলো।
আমি বললাম,- ‘কি আর করা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’
সাজিদ বললো,- ‘তোদের এই এক দোষ,বুঝলি? দেখছিস পুওর এ্যাটেন্ডেন্সের জন্য এক বছর ড্রপ খাওয়াচ্ছে, তার মধ্যেও বলছিস, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাই, এইখানে কোন ভালোটা তুই পাইলি,বলতো?’
সাজিদ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার।আমি আর সাজিদ রুমমেট। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো বায়োলজিতে পড়ে।প্রথম জীবনে খুব ধার্মিক ছিলো।নামাজ-কালাম করতো।বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিভাবে কিভাবে যেন এগনোষ্টিক হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে এখন পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে গেছে।ধর্মকে এখন সে আবর্জনা জ্ঞান করে।তার মতে পৃথিবীতে ধর্ম এনেছে মানুষ।আর ‘ইশ্বর’ ধারনাটাই এইরকম স্বার্থান্বেষী কোন মহলের মস্তিষ্কপ্রসূত।
.
সাজিদের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে জড়াবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তাকে একদম ইগনোর করেও যাওয়া যায়না।
.
আমি বললাম,- ‘আমার সাথে তো এর থেকেও খারাপ কিছু হতে পারতো,ঠিক না?’
– ‘আরে, খারাপ হবার আর কিছু বাকি আছে কি?’
— ‘হয়তো।’
– ‘যেমন?’
– ‘এরকমও তো হতে পারতো,ধর, আমি সারাবছর একদমই পড়াশুনা করলাম না।পরীক্ষায় ফেইল মারলাম।এখন ফেইল করলে আমার এক বছর ড্রপ যেতো।হয়তো ফেইলের অপমানটা আমি নিতে পারতাম না।আত্মহত্যা করে বসতাম।’
সাজিদ হা হা হা হা করে হাসা শুরু করলো। বললো,- ‘কি বিদঘুটে বিশ্বাস নিয়ে চলিস রে ভাই।’
এই বলে সে আবার হাসা শুরু করলো।বিদ্রুপাত্মক হাসি।
রাতে সাজিদের সাথে আমার আরো একদফা তর্ক হোলো।
.
সে বললো,- ‘আচ্ছা, তোরা যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করিস, কিসের ভিত্তিতে?’
আমি বললাম,- ‘বিশ্বাস দু ধরনের। একটা হোলো, প্রমানের ভিত্তিতে বিশ্বাস।অনেকটা,শর্তারোপে বিশ্বাস বলা যায়। অন্যটি হোলো প্রমান ছাড়াই বিশ্বাস।’
সাজিদ হাসলো। সে বললো,- ‘দ্বিতীয় ক্যাটাগরিকে সোজা বাঙলায় অন্ধ বিশ্বাস বলে রে আবুল,বুঝলি?’
আমি তার কথায় কান দিলাম না। বলে যেতে লাগলাম-
.
‘প্রমানের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস, সেটা মূলত বিশ্বাসের মধ্যে পড়েনা।পড়লেও, খুবই ট্যাম্পোরেরি। এই বিশ্বাস এতই দূর্বল যে, এটা হঠাৎ হঠাৎ পালটায়।’
সাজিদ এবার নড়েচড়ে বসলো। সে বললো,- ‘কি রকম?’
আমি বললাম,- ‘এই যেমন ধর,সূর্য আর পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের একটি আদিম কৌতূহল আছে। আমরা আদিকাল থেকেই এদের নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঠিক না?’
– ‘হু, ঠিক।’
– ‘আমাদের কৌতূহল মেটাতে বিজ্ঞান আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, ঠিক?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমরা একাট্টা ছিলাম। আমরা নির্ভুলভাবে জানতে চাইতাম যে, সূর্য আর পৃথিবীর রহস্যটা আসলে কি। সেই সুবাধে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নানান সময়ে নানান তত্ব আমাদের সামনে এনেছেন। পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে প্রথম ধারনা দিয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতির বিজ্ঞানি টলেমি।টলেমি কি বলেছিলো সেটা নিশ্চয় তুই জানিস?’
সাজিদ বললো,- ‘হ্যাঁ। সে বলেছিলো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে।’
– ‘একদম তাই। কিন্তু বিজ্ঞান কি আজও টলেমির থিওরিতে বসে আছে? নেই। কিন্তু কি জানিস, এই টলেমির থিওরিটা বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিলো পুরো ২৫০ বছর। ভাবতে পারিস? ২৫০ বছর পৃথিবীর মানুষ, যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানি, ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, তারাও বিশ্বাস করতো যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।
এই ২৫০ বছরে তাদের মধ্যে যারা যারা মারা গেছে, তারা এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।’
.
সাজিদ সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,- ‘তাতে কি? তখন তো আর টেলিস্কোপ ছিলো না, তাই ভুল মতবাদ দিয়েছে আর কি। পরে নিকোলাস কোপারনিকাস এসে তার থিওরিকে ভুল প্রমান করলো না?’
– ‘হ্যাঁ। কিন্তু কোপারনিকাসও একটা মস্তবড় ভুল করে গেছে।’
সাজিদ প্রশ্ন করলো,- ‘কি রকম?’
– ‘অদ্ভুত! এটা তো তোর জানার কথা। যদিও কোপারনিকাস টলেমির থিওরির বিপরীত থিওরি দিয়ে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে।কিন্তু, তিনি এক জায়গায় ভুল করেন।এবং সেই ভুলটাও বিজ্ঞান মহলে বীরদর্পে টিকে ছিলো গোটা ৫০ বছর।’
– ‘কোন ভুল?’
– ‘উনি বলেছিলেন, পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, কিন্তু সূর্য ঘোরে না। সূর্য স্থির। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলে, – নাহ, সূর্য স্থির নয়। সূর্যও নিজের কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণনরত অবস্থায়।’
সাজিদ বললো,- ‘সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু বিজ্ঞানের এটাই নিয়ম যে, এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে। এখানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছুই নেই।’
– ‘একদম তাই। বিজ্ঞানে শেষ/ফাইনাল বলে কিছু নেই। একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি ২ সেকেন্ডও টেকে না, আবার আরেকটা ২০০ বছরও টিকে যায়। তাই, প্রমান বা দলিল দিয়ে যা বিশ্বাস করা হয় তাকে আমরা বিশ্বাস বলিনা।এটাকে আমরা বড়জোর চুক্তি বলতে পারি। চুক্তিটা এরকম,- ‘তোমায় ততোক্ষণ বিশ্বাস করবো, যতক্ষণ তোমার চেয়ে অথেনটিক কিছু আমাদের সামনে না আসছে।’
.
সাজিদ আবার নড়েচড়ে বসলো। সে কিছুটা একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
.
আমি বললাম,- ‘ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার ধারনা/অস্তিত্ব হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। দ্যাখ, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যকার এই গূঢ় পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধর্মগ্রন্থের শুরুতেই বিশ্বাসের কথা বলা আছে। বলা আছে- ‘এটা তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে।’ (সূরা বাকারা,০২)।
.
যদি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল কিছু থাকতো, তাহলে হয়তো ধর্মগ্রন্থের শুরুতে বিশ্বাসের বদলে বিজ্ঞানের কথাই বলা হতো। হয়তো বলা হতো,- ‘এটা তাদের জন্যই যারা বিজ্ঞানমনষ্ক।’
কিন্তু যে বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, যে বিজ্ঞানের নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তাকে কিভাবে অন্যরা বিশ্বাস করবে?’
.
সাজিদ বললো,- ‘কিন্তু যাকে দেখিনা, যার পক্ষে কোন প্রমান নেই, তাকে কি করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি?’
– ‘সৃষ্টিকর্তার পক্ষে অনেক প্রমান আছে, কিন্তু সেটা বিজ্ঞান পুরোপুরি দিতে পারেনা।এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সৃষ্টিকর্তার নয়।বিজ্ঞান অনেক কিছুরই উত্তর দিতে পারেনা। লিষ্ট করতে গেলে অনেক লম্বা একটা লিষ্ট করা যাবে।’
.
সাজিদ রাগি রাগি গলায় বললো,- ‘ফাইজলামো করিস আমার সাথে?’
আমি হাসতে লাগলাম। বললাম,- ‘আচ্ছা শোন, বলছি। তোর প্রেমিকার নাম মিতু না?’
– ‘এইখানে প্রেমিকার ব্যাপার আসছে কেনো?’
– ‘আরে বল না আগে।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কিছু মনে করিস না। কথার কথা বলছি। ধর, আমি মিতুকে ধর্ষণ করলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় মিতু তার বেডে পড়ে আছে। আরো ধর, তুই কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছিস।’
– ‘হু।’
– ‘এখন বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা কর দেখি, মিতুকে ধর্ষণ করায় কেনো আমার শাস্তি হওয়া দরকার?’
সাজিদ বললো,- ‘ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান। এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে কিভাবে
ব্যাখ্যা করবো?’
– ‘হা হা হা। আগেই বলেছি। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার উত্তর বিজ্ঞানে নেই।’
– ‘কিন্তু এর সাথে স্রষ্টায় বিশ্বাসের সম্পর্ক কি?’
– ‘সম্পর্ক আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাসটাও এমন একটা বিষয়, যেটা আমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য প্রমানাদি দিয়ে প্রমান করতে পারবো না। স্রষ্টা কোন টেলিষ্কোপে ধরা পড়েন না।উনাকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা যায়না। উনাকে জাষ্ট ‘বিশ্বাস করে নিতে হয়।’
.
সাজিদ এবার ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে বসলো। সে বললো,- ‘ধুর! কিসব বাল ছাল বুঝালি। যা দেখিনা, তাকে বিশ্বাস করে নেবো?’
আমি বললাম,- ‘হ্যাঁ। পৃথিবীতে অবিশ্বাসী বলে কেউই নেই। সবাই বিশ্বাসী। সবাই এমন কিছু না কিছুতে ঠিক বিশ্বাস করে, যা তারা আদৌ দেখেনি বা দেখার কোন সুযোগও নেই।কিন্তু এটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলে না। তারা নির্বিঘ্নে তাতে বিশ্বাস করে যায়। তুইও সেরকম।’
.
সাজিদ বললো,- ‘আমি? পাগল হয়েছিস? আমি না দেখে কোন কিছুতেই বিশ্বাস করিনা, করবোও না।’
– ‘তুই করিস।এবং, এটা নিয়ে তোর মধ্যে কোনদিন কোন প্রশ্ন জাগে নি।এবং, আজকে এই আলোচনা না করলে হয়তো জাগতোও না।’
.
সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম,- ‘জানতে চাস?’
– ‘হু।’
– ‘আবার বলছি, কিছু মনে করিস না। যুক্তির খাতিরে বলছি।’
– ‘বল।’
– ‘আচ্ছা, তোর বাবা-মা’র মিলনেই যে তোর জন্ম হয়েছে, সেটা তুই দেখেছিলি? বা,এই মূহুর্তে কোন এভিডেন্স আছে তোর কাছে? হতে পারে তোর মা তোর বাবা ছাড়া অন্য কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেছে তোর জন্মের আগে। হতে পারে, তুই ঐ ব্যক্তিরই জৈব ক্রিয়ার ফল।তুই এটা দেখিস নি।
.
কিন্তু কোনদিনও কি তোর মা’কে এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলি? করিস নি। সেই ছোটবেলা থেকে যাকে বাবা হিসেবে দেখে আসছিস, এখনো তাকে বাবা ডাকছিস। যাকে ভাই হিসেবে জেনে আসছিস, তাকে ভাই।বোনকে বোন।
.
তুই না দেখেই এসবে বিশ্বাস করিস না? কোনদিন জানতে চেয়েছিস তুই এখন যাকে বাবা ডাকছিস, তুই আসলেই তার ঔরসজাত কিনা? জানতে চাস নি। বিশ্বাস করে গেছিস।এখনো করছিস। ভবিষ্যতেও করবি। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই রে।এটাকে প্রশ্ন করা যায়না। সন্দেহ করা যায়না। এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারন করতে হয়। এটার নামই বিশ্বাস।’
সাজিদ উঠে বাইরে চলে গেলো। ভাবলাম, সে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে হয়তো।
পরেরদিন ভোরে আমি যখন ফজরের নামাজের জন্য অযূ করতে যাবো, দেখলাম, আমার পাশে সাজিদ এসে দাঁড়িয়েছে।আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।সে আমার চাহনির প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছে। সে বললো,- ‘নামাজ পড়তে উঠেছি।’
.
‘একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস’
লেখকঃ আরিফ আজাদ
লেখক

আরিফ আজাদ বই

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “সত্যকথন – আরিফ আজাদ”

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button